‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূলে রয়েছে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মদিনা ইয়াছমিন।
আমাদের মাছে ভাতে বাঙালি পরিচয় বেশ প্রাচীন থেকেই। আর এই প্রবাদের পূর্ণতা আনেন তো নারীরাই। কিন্তু এই নারীই যদি হন মাছ চাষে সফল একজন উদ্যোক্তা,তাহলে তো অবাক করা ব্যাপারই। বলছিলাম ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মদিনা ইয়াছমিনের কথা। বয়স ৪১ বছর। উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের মুজিবুর রহমানের স্ত্রী মদিনা। জীবন চালাতে এক সময় হিমশিম খেতে হতো মদিনা ইয়াছমিনকে। ১০ বছর আগে একটি পুকুর দিয়ে শুরু করেন মৎস্য চাষ। তবে বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ শুরু করেন ২০১৭ সাল থেকে। এখন তার রয়েছে মাছ ভর্তি পাঁচটি পুকুর।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ প্রকল্পের আওতায় গঠিত গুইলাকান্দা সিআইজ সমিতির সদস্য হন মদিনা। গত বছর তিনি টেংরা ও মাগুর একসাথে চাষ করে সফল হয়েছেন। মদিনা জানান, চাষের শুরু থেকেই সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ,এসএম সানোয়ার রাসেল ও লিফের পরামর্শে পুকুর গুলোতে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে মাগুর ও টেংরা একসাথে চাষ করেন। এতে শতক প্রতি ২শ গ্রাম ওজনের ১২৫ টি মাগুর ও পুকুরের ৪০০০ লাইনে টেংরা মাছের পোনা মজুদ করেন। তখন পুকুরে মোট মাগুর উৎপাদন হয়েছিল ১২০০ কেজি,যার বিক্রয়মূল্য ছিল ৩,৬০,০০০ টাকা। অপরদিকে টেংরা উৎপাদিত হয়েছিল ৪৯০ কেজি,যার বিক্রয়মূল্য ছিলো ১,৯২,০০০ টাকা । খরচ বাদে ওই বছর মোট লাভ হয়েছিল ৩,২২,০০০ টাকা।
বর্তমানে মদিনা ইয়াছমিনের ৫টি পুকুরে চার প্রজাতির মাছ রয়েছে। চলতি বছর পুকুরগুলোতে রয়েছে-পাবদা মাছ ৮০ হাজার,টেংরা ২০ হাজার,মাগুর-২৫ হাজার, শিং ১ লাখ ২০ হাজার। ইতোমধ্যে পাঁচটি পুকুরে মৎস্য খাদ্য ও চাষ বাবদ দুই থেকে আড়াই লক্ষ্য টাকা খরচ হয়েছে। আগামী দুই আড়াই মাসের মধ্যে মাছগুলো বিক্রির উপযোগী হবে।এতে আনুমানিক ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। মদিনা আশা করছেন এবার ১০ লাখ টাকারও বেশি মাছ বিক্রি করতে পারবেন। সেখান থেকে তিনি ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা লাভের আশা করছেন।
মদিনা শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন,তিনি একজন সফল মাও। মদিনা তিন পুত্র সন্তানের জননী। বড় ছেলে মুকসিদুল হাসান পরান মেডিকেল থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে ইন্টার্নি করছেন। মেঝো ছেলে মশিউর রহমান স্থানীয় সোহাগী জামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগে পড়েন। আর ছোট ছেলে মাহফুজুর রহমান সোহাগী নিউ ভিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। এছাড়াও গত বছর বেগম রোকেয়া দিবসে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে পেয়েছেন সম্মাননা স্মারক।
মদিনা ইয়াছমিন জানান, বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন আর সমাজের বোঝা নই, আমরা সম্পদ। আর সম্পদ হিসেবে দেশের উন্নয়নে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে জন্য আমাদের উদ্যোক্তা হতে হবে। তিনি আরও জানান, আমি নারী হয়েও মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছি এবং এলাকাবাসী আমাকে নিয়ে প্রশংসা করে। আমার স্বামীও আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেন।পাশাপাশি উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে সরকারি কর্মকর্তারাও আমার খোঁজ খবর নেন। আমি আশাবাদী অন্য নারীরাও আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হবেন ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
মদিনার স্বামী মুজিবুর রহমান বলেন, মহেশপুর বাজারে আমার ওষুধের একটি ফার্মেসী রয়েছে। বহু বছর ধরে ওষুধ বিক্রি করার কারণে মানুষ আমাকে ডাক্তার বলে ডাকে। আর এই ফার্মেসী বা ডাক্তারীর কারণে আমি বাড়িতে বেশি সময় দিতে পারি না। বাড়ির সবকিছু আমার স্ত্রী দেখাশোনা করে। বাড়িতে পাঁচটি পুকুরে আমার স্ত্রী মাছের চাষ করেছেন। আমিও তাকে অর্থ, পরামর্শ ও নানা ভাবে সাহায্য করে থাকি। আমার স্ত্রীকে দেখে এলাকার অনেকেই মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ,এসএম সানোয়ার রাসেল জানান, মদিনা ইয়াছমিন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। গতবছর তিনি মাগুর ও টেংরা একসাথে চাষ করে সফল হয়েছেন। সে সময় উপজেলা মৎস অফিস থেকে প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হয়। এই কর্মকর্তা আরও বলেন , গতবছর মদিনা ইয়াছমিনকে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়েছিল। উপজেলা মৎস্য অফিস উদ্যোক্তাদের পাশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।