নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির তদন্ত কমিটিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাই কমিটির সচিব
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য গঠিত ‘সত্যান্বেষণ কমিটি’র দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার মো. আমিনুল ইসলামকে কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার নিজের বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, সরকার পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা সত্যান্বেষণ কমিটির অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করে। এগুলো হলো- প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি, একাডেমিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার অপরাধ তদন্ত কমিটি
এই তিনটি কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন সিন্ডিকেট সদস্য। এর মধ্যে প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর আক্তার হোসেন মজুমদার। তার কমিটিতেই সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছেন উপ-রেজিস্ট্রার মো. আমিনুল ইসলাম।
সত্যান্বেষণ কমিটির প্রতিবেদনের ৪৪ নম্বর অভিযোগে উপ-রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে অবৈধ নিয়োগে সহযোগিতা এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ এনেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহিত উল আলমের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত হিসেবে আমিনুল ইসলাম এবং তৎকালীন সহকারী রেজিস্ট্রার আহসান হাবিব একদল ছাত্রলীগ ক্যাডারকে বিভিন্ন অফিসার পদে অবৈধভাবে নিয়োগে সহায়তা করেন এবং এর বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর, সত্যান্বেষণ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯ জন শিক্ষক এবং ২০ জন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিবেদনে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও উপ-রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলামকে কোনো শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়নি।
এদিকে শোকজ নোটিশ পাওয়া কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাদের বিরুদ্ধে পুরনো এবং মীমাংসিত অভিযোগগুলো নতুন করে সামনে আনা হয়েছে। অন্যদিকে, সত্যান্বেষণ কমিটির প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল, তাদের অনেককেই শোকজ করা হয়নি।
এসব ছাত্রলীগ নেতার মধ্যে জাকিবুল হাসান রনি, আবু বক্কর সিদ্দিক, ইব্রাহিম খলিল শান্ত ও মাহমুদুল হাসান লিমন উল্লেখযোগ্য। এদের অধিকাংশই বর্তমানে সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-সমর্থিত সাদা দলের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, আমিনুল ইসলাম এই ছাত্রলীগ নেতাদের চাকরি দিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। তাদের মতে, এই ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যখন তদন্তের সময় এসেছে, তখন তাদের ‘অভিভাবক’ হিসেবে পরিচিত আমিনুল ইসলামকে তদন্ত কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন শরীরচর্চা বিভাগের উপ-পরিচালক ওমর ফারুক সরকার এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পার্সোনাল অফিসার রোজিনা বেগম। তারা দুজনেই বলেছেন, তাদের নামে সত্যান্বেষণ কমিটিতে কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও তাদের শোকজ করা হয়েছে। রোজিনা বেগম আরও জানান, তিনি এখনো জানেন না তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের উপ রেজিস্ট্রার (স্টোর) নাজমুল হুদা জানান, আমি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালে দশম গ্রেডে যোগদান করি। দীর্ঘদিন চাকরি করার পর প্রশাসন যাচাই-বাছাই করেই আমাদেরকে প্রোমোশন দেয়। এখন হঠাৎ করেই আমাকে চিঠি দেয়, আমি কিভাবে প্রমোশন পেলাম? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে যে কোন কিছু করতে পারে। এক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নেই।
সাচিবিক দায়িত্ব পালন করা উপ রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সত্যান্বেষণ কমিটিতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কিনা এটি আমি বলতে পারব না। প্রাথমিক কমিটিতে আমি সদস্য হিসেবে ছিলাম, কিন্তু পরে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেন প্রথম কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের কমিটির কাজ করার সময় আমাকে বাইরে রাখা হতো। কেন অব্যাহতি দিয়েছে এটি সেই কমিটির প্রধান বলতে পারবেন।
সাদা দলের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগ নেতাদের পুনর্বাসনকারী হিসেবে অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তাকেই যখন দুর্নীতির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সুষ্ঠু বিচার ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জানান, সিন্ডিকেট থেকে প্রতিটি তদন্ত কমিটির আহ্বায়ককে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং তারাই তাদের কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব কে পালন করবেন তা নির্ধারণ করেছেন।
প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির প্রধান প্রফেসর আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, যদি সাচিবিক দায়িত্বে থাকা আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তাহলে তিনি অবশ্যই আইনের আওতায় আসবেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলে তিনি আর এই দায়িত্বে থাকবেন না।
এই বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমের মন্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।