প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, ছোট হোক বা বড় হোক, সব প্রকার শিরক থেকে মুক্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ নিজের মধ্যে শিরকের ছিটাফোঁটাও থাকতে পারবে না। নিজের ভেতর থেকে এটিকে এমনভাবে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে যাতে সেখান থেকে পুনরায় শিরকের চারা গাছ না গজাতে পারে। মনে রাখতে হবে, এটিকে অন্যান্য ছোট ছোট গুনাহের মতো মনে করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ) বলো, আমি তো একজন মানুষ তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি ওহি করা হয় এ মর্মে যে, এক আল্লাহ তোমাদের ইলাহ, কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার সৎকাজ করা উচিত ও বন্দেগির ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরিক করা উচিত নয়’ (সূরা আল কাহফ-১১০)।
ইমাম হাকিম তার মুসতাদরিকে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেছেন, জনৈক মুসলমান আল্লাহর পথে জিহাদ করত ও মনে মনে কামনা করত যে, জনসমাজে শৌর্য-বীর্য প্রচারিত হোক। তার সম্পর্কে উল্লিখিত আয়াতটি নাজিল হয়। (তাফসিরে মারেফুল কুরআন) ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে আবিদ্দুনিয়া কিতাবুল ইখলাসে তাউস থেকে বর্ণনা করেন, একবার জনৈক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে বললেন, আমি মাঝে মধ্যে কোনো সৎকর্ম সম্পাদনের অথবা ইবাদতের উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিই থাকে আমার উদ্দেশ্য, কিন্তু সাথে সাথে এ কামনাও মনে জাগে, লোকেরা আমার কাজটি দেখুক। রাসূলুল্লাহ সা: এ কথা শুনে চুপ করে রইলেন, অবশেষে উল্লিখিত আয়াত নাজিল হয়। আবু নাঈম ‘তারিখে আসাকিরে’ হজরত ইবনে আব্বাস রা:-এর বর্ণনায় লিখেছেন। জুনদুব ইবনে সুহায়েব যখন সালাত পড়তেন, রোজা রাখতেন অথবা দান-খয়রাত করতেন এবং এসব আমলের কারণে লোকদের তার প্রশংসা করতে দেখতেন, তখন মনে মনে খুব আনন্দিত হতেন। আমল আরো বাড়িয়ে দিতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়।
আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যাকে শহীদ করা হয়েছিল। তাকে আল্লাহর নিকট হাজির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। আর সে তা যথারীতি স্বীকারও করবে। তখন আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এসব নিয়ামত পেয়ে তুমি দুনিয়াতে কী আমল করেছিলে? উত্তরে সে বলবে, আমি আপনার পথে লড়াই করেছি।
এমনকি আমাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; বরং তুমি লড়াই করেছ এ জন্য যে, তোমাকে যেন বীরবাহাদুর বলা হয়। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে আদেশ হবে। তখন তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর ইলম অর্জনকারী, এরপর বিত্তবান ও বিপুল ধনসম্পদ অধিকারীর দানশীলের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার জন্য জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (মুসলিম)।
কিন্তু কিছু সহিহ হাদিস থেকে বিপরীতও জানা যায়। উদাহরণত- তিরমিজি হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- একবার তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আরজ করলেন, আমি মাঝে মধ্যে আমার ঘরের ভেতরে জায়নামাজে থাকি। হঠাৎ কোনো ব্যক্তি এসে গেলে আমার কাছে ভালো লাগে যে, সে আমাকে সালাতরত অবস্থায় দেখেছে। এটি কি রিয়া হবে? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আবু হোরায়রা! আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন। এমতাবস্থায় তুমি দু’টি সওয়াব পাবে। একটি তোমার সে গোপন আমলের জন্য যা তুমি আগে থেকে করছিলে এবং দ্বিতীয়টি তোমার প্রকাশ্য আমলের জন্য যা লোকটি আসার পর হয়েছে।’
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে- একবার হজরত আবু জার গিফারি রা: রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বলুন, যেকোনো সৎকর্ম করার পর মানুষের মুখে তার প্রশংসা শোনে। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘এটি তো মুমিনের নগদ সুসংবাদ’।
তাফসিরে মাজহারিতে বলা হয়েছে- নিজের আমল দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির সাথে সৃষ্টি জীবের সন্তুষ্টি অথবা নিজের সুখ্যাতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির নিয়তকে শরিক করে নেয়া এমনকি, লোকমুখে প্রশংসা শুনে আমল আরো বাড়িয়ে দেয়া, এটি নিঃসন্দেহে রিয়া ও গোপন শিরক। কিন্তু তিরিমিজি ও মুসলিমের বর্ণিত রেওয়ায়েতের তাৎপর্য এই- আমল খাঁটিভাবে আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে, লোকমুখে সুখ্যাতি ও প্রশংসার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ থাকে না। অতঃপর যদি আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে লোকের মধ্যে তার প্রসিদ্ধি সম্পন্ন করে দেন এবং মানুষের মুখ দিয়ে প্রশংসা করিয়ে দেন, তবে রিয়ার সাথে এ আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি মুমিনের জন্য আমল কবুল হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদ। তবে এর বাইরে নিয়তে যদি সামান্য পরিমাণ ত্রুটি থাকে তাহলে রিয়া বা ছোট শিরক হিসেবে সব আমল ব্যর্থ হবে, সেই সাথে শিরকের গুনাহে অপরাধী সাব্যস্ত হবে।
হজরত মাহমুদ ইবনে লবিদ রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমি তোমাদের সম্পর্কে যে বিষয় সর্বাধিক আশঙ্কা করি, তা হচ্ছে ছোট শিরক।’ সাহাবায়ে কেরাম নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ছোট শিরক কি? তিনি বললেন, ‘রিয়া বা লোক দেখানো’ (আহমাদ)। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি শিরকদের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ঊর্ধ্বে। যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে এবং তাতে আমার সাথে অন্যকেও শরিক করে আমি সেই আমল শরিকের জন্য ছেড়ে দেই।’ অন্য বর্ণনায়- ‘আমি সেই আমল থেকে মুক্ত। সে আমলকে খাঁটিভাবে আমি তার জন্য করে দেই, যাকে সে আমার সাথে শরিক করেছিল (মুসলিম)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুখ্যাতি লাভের জন্য সৎকর্ম করে, আল্লাহ তায়ালাও তার সাথে এমনি ব্যবহার করেন; যার ফলে সে ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত হয়ে যায় (আহমাদ, বায়হাকি ও মাজহারি)। তাফসিরে কুরতুবিতে আছে- হজরত হাসান বসরি রা:-কে ইখলাস ও রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ইখলাস হচ্ছে সৎ ও ভালো কাজের গোপনীয়তা পছন্দ করা এবং মন্দ কাজের গোপনীয়তা পছন্দ না করা। এরপর যদি আল্লাহ তায়ালা তোমার আমল মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেন, তাহলে তুমি এ কথা বলো- হে আল্লাহ! এটি তোমার কৃপা ও অনুগ্রহ; আমার কর্ম ও প্রচেষ্টার ফল নয়।’
ঈমাম তিরমিজি হজরত আবু বকর ছিদ্দিক রা: থেকে বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ সা: শিরকের আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন- পিঁপড়ার নিঃশব্দ গতির মতোই শিরক তোমাদের মধ্যে গোপনে অনুপ্রবেশ করে।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে একটি উপায় বলে দিচ্ছি যা করলে তোমরা বড় শিরক ও ছোট শিরক থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। তোমরা দৈনিক তিনবার এই দোয়া পাঠ করো- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আলামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা রা আলামুহু।’
শিরকের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। শিরক একটি জুলুম এবং আল কুরআনে যাকে সবচেয়ে বড় জুলুম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শিরকমূলক অপরাধ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য গুনাহ যা আছে তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরিক করেছে সে তো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গোনাহের কাজ করছে’ (সূরা নিসা-৪৮)।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট